রবিবার, ২৯ Jun ২০২৫, ০৯:০১ পূর্বাহ্ন
মুফতি এনায়েতুল্লাহ:
মানুষের কোনো ইচ্ছাপূরণ না হলে, কোনো কাজের আশানুরূপ ফল না পেলে যে মানসিক অবসাদের সৃষ্টি হয়, তা-ই হতাশা; এটা মানবিক দুর্বলতাও বটে। আল্লাহতায়ালা এমন দুর্বলতাকে প্রশ্রয় দিতে নিষেধ করেছেন। ইসলাম বলে, যে ব্যক্তি আল্লাহর ওপর দৃঢ় বিশ্বাস রাখে এবং সব বিষয়ে আল্লাহর ওপরই ভরসা করে, দুনিয়ার কোনো দুঃখ, ব্যর্থতা, পরাজয়, অপ্রাপ্তি, বিপদ, রোগব্যাধি তাকে হীনবল করতে পারে না। সব পরিস্থিতিতে সে মহান আল্লাহর ওপর ভরসা করে ধৈর্যধারণের শক্তি পায়। অনেকে নানা কারণে নিজেকে গুরুত্বহীন, দুর্বল ও অসহায় মনে করে হতাশ হয়ে পড়েন। এমন নেতিবাচক চিন্তা কাম্য নয়, এটা এক ধরনের হীনম্মন্যতা।
ইসলামি স্কলারদের মতে, মানবচরিত্রের একটি নেতিবাচক দিক এটি। আকাক্সক্ষা পূরণে উল্লাস আর আশাভঙ্গে অতিরিক্ত বেদনাবোধ মানুষের স্বভাবজাত দুর্বলতা। পছন্দের কিছু ঘটলে মানুষ আনন্দের সীমা অতিক্রম করে উল্লসিত হয়ে ওঠে। পক্ষান্তরে অনাকাক্সিক্ষত ঘটনায় মানুষ মাত্রাতিরিক্ত দুঃখবোধের শিকার হয়। এই উভয় প্রবণতা দূর করে ভারসাম্যের পথ অবলম্বন করার শিক্ষা দেয় কোরআন মজিদ।
আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘পৃথিবীতে এবং তোমাদের প্রাণের ওপর যে মসিবতই আসে, তা একটি কিতাবে (লওহে মাহফুজে) লিপিবদ্ধ আছে, আমি তা সৃষ্টির বহু আগেই। এটি আল্লাহর পক্ষে অতি সহজ। (তোমাদের এ বিষয়ে জানিয়ে দেওয়া হলো) যেন তোমরা যা হারাও বা না পাও তার জন্য মুষড়ে না পড়ো এবং যা আল্লাহ তোমাদের দান করেন তার জন্য উল্লসিত না হও। আল্লাহ কোনো দাম্ভিক অহংকারীকে পছন্দ করেন না।’ সুরা হাদিদ : ২৩-২৪
এ আয়াত বলছে, পৃথিবীতে এবং মানুষের জীবনে ভালো-মন্দ যা কিছু ঘটে সবকিছু লওহে মাহফুজে লিখিত তাকদির অনুযায়ী ঘটে। কাজেই কোনো অপ্রীতিকর ঘটনায় অতিরিক্ত দুঃখ পাওয়ার কিছু নেই। অনাকাক্সিক্ষত ঘটনায় মানবীয় দুর্বলতাবশত মনে তো কিছুটা কষ্ট জন্মেই থাকে। কিন্তু সেই কষ্ট জিইয়ে রাখা কিংবা অতিরিক্ত দুঃখবোধের শিকার হওয়া উচিত নয়। বরং সবকিছুই আল্লাহর ফায়সালায় হয় এ বিশ্বাস মনে রেখে ধৈর্য ধারণ করা।
হাদিসে বিষয়টি এভাবে আলোকপাত করা হয়েছে। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘এক দিন আমি নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পেছনে সওয়ারিতে বসা ছিলাম। তিনি আমাকে বললেন, বৎস! আমি তোমাকে কিছু কথা শেখাচ্ছি। তুমি আল্লাহকে হেফাজত করবে (তার হুকুম-আহকাম মেনে চলবে), তাহলে আল্লাহও তোমাকে হেফাজত করবেন। তুমি আল্লাহকে হেফাজত করবে, তাহলে তাকে তোমার সামনে পাবে। যখন চাইবে তো আল্লাহর কাছে চাইবে। সাহায্য-প্রার্থনা করবে, তো আল্লাহর কাছে সাহায্য-প্রার্থনা করবে। জেনে রেখো, যদি গোটা উম্মত (মানব প্রজাতি) একজোট হয় তোমার কোনো উপকার করার জন্য, তারা তোমার কোনোরূপ উপকার সাধনে সমর্থ হবে না; শুধু ততটুকুই তাদের পক্ষে সম্ভব হবে, যা আল্লাহ তোমার জন্য লিখে রেখেছেন। আর যদি তারা একজোট হয় তোমার কোনো ক্ষতি করার জন্য, তোমার কোনোরূপ ক্ষতিসাধনে সমর্থ হবে না; শুধু ততটুকুই তাদের পক্ষে সম্ভব হবে, যা আল্লাহ তোমার জন্য লিখে রেখেছেন।’ জামে তিরমিজি : ২৫১৬
বর্ণিত হাদিস থেকে আমরা শিক্ষা পাই, জীবনে ভালো-মন্দ যা কিছু ঘটে তা পূর্ব থেকেই তাকদিরে লিখিত আছে। কাজেই কোনো কিছু হারালে বা কাক্সিক্ষত কিছু না পেলে অতিরিক্ত কষ্ট পাওয়ার কিছু নেই। কারণ এই অপ্রাপ্তি আল্লাহর ফায়সালাতেই হয়েছে। তদ্রুপ কোনো কিছু অর্জিত হলে উল্লসিত হওয়ারও কিছু নেই। কারণ এই প্রাপ্তি শুধুই আমার প্রচেষ্টার ফল নয়, বরং তা আল্লাহর দান।
এখানে একটি বিষয় স্পষ্ট থাকা দরকার, আল্লাহ কার তাকদিরে কী লিখে রেখেছেন তা কারও জানা নেই, এর পেছনে পড়ে থাকারও দরকার নেই। মানুষের দায়িত্ব হলো নিষ্ঠার সঙ্গে আপন কর্তব্যকর্ম করে যাওয়া। কারণ নিষ্ঠার সঙ্গে চেষ্টা করে গেলে আল্লাহ তার জন্য নেক কর্মের পথ খুলে দেন।
কোরআনে কারিমে এ প্রসঙ্গে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমাদের প্রচেষ্টা বিভিন্ন ধরনের। (কাজেই তার ফলাফলও বিভিন্ন)। সুতরাং যে আল্লাহর পথে অর্থসম্পদ দান করে এবং তাকওয়া অবলম্বন করে এবং উত্তম বিষয়কে (ইসলামকে) সত্য বলে স্বীকার করে, আমি অবশ্যই তার জন্য সহজ করব (তওফিক দেব) সহজতম বিষয় (নেক আমল এবং নেক আমলের পথ ধরে জান্নাত)। পক্ষান্তরে যে কৃপণতা করে, বেপরোয়া থাকে এবং উত্তম বিষয়কে (ইসলামকে) অস্বীকার করে, আমি অবশ্যই তার জন্য সহজ করব কঠিনতম বিষয় (জাহান্নম)।’ সুরা আল লাইল : ৪-১০
বর্ণিত আয়াত থেকে বোঝা যাচ্ছে, নিষ্ঠার সঙ্গে নেক কর্মে লেগে থাকলে আল্লাহ তার জন্য পুণ্যের পথ এবং পুণ্যের পথ ধরে জান্নাতের পথ সুগম করে দেন। পক্ষান্তরে কেউ হঠকারিতা করে বিপরীত পথ অবলম্বন করতে চাইলে তার পথও রোধ করা হয় না। তাকে আপন গতিতে চলতে দেওয়া হয়।
সুতরাং মুমিনের কর্তব্য, নিষ্ঠার সঙ্গে কর্তব্যকর্মে লেগে থাকা। তাহলে আল্লাহ তার জন্য নেক কাজের পথ সুগম করে দেবেন। কিছু হারালে কিংবা কোনো কিছুর অপ্রাপ্তিতে অতিরিক্ত দুঃখবোধের শিকার না হওয়া। বরং তাকদিরের ফায়সালা অনুযায়ী সবকিছু হয় এ বিশ্বাস মনে রেখে ধৈর্য ধারণ করা। অর্জিত কোনো বিষয়কে শুধু আপন চেষ্টার ফল মনে করে উল্লাসের শিকার না হওয়া। বরং তা আল্লাহর অনুগ্রহের ফল, এই বিশ্বাস বুকে ধারণ করে তার কৃতজ্ঞতা আদায় করা।
লেখক : শিক্ষক ও ইসলামবিষয়ক গবেষক
muftianaet@gmail.com
ভয়েস/আআ